International

মাহফিলে ‘তুমি’ সম্বোধনের কারণ নিয়ে আজহারীর বক্তব্য: ধর্মীয় সংস্কৃতির এক নতুন অধ্যায়

মাহফিলে ‘তুমি’ সম্বোধনের কারণ নিয়ে আজহারীর বক্তব্য: ধর্মীয় সংস্কৃতির এক নতুন অধ্যায়

 

সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী আলোচক মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে লাখো মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। বিশেষত সিলেট মহানগরীর এমসি কলেজ মাঠে আয়োজিত এক বিশাল মাহফিলে তাঁর বক্তব্য ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আজহারীর বক্তব্যে শ্রোতাদের প্রতি ‘তুমি’ সম্বোধনের বিষয়টি।

আজহারীর মতো একজন আলোচকের এমন একটি ভিন্নধর্মী উপস্থাপনা বহু প্রশ্ন এবং মন্তব্যের জন্ম দিয়েছে। এই লেখায় আমরা আলোচনা করব কেন তিনি ‘তুমি’ সম্বোধনকে বেছে নিলেন, এর পেছনে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং এর মাধ্যমে তিনি কী বার্তা দিতে চেয়েছেন।

‘তুমি’ সম্বোধন: একটি ভিন্নধর্মী প্রয়াস

মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী সাধারণত তাঁর বক্তব্যে শ্রোতাদের প্রতি অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় কথা বলেন। সিলেটের এই মাহফিলে তিনি ‘তুমি’ সম্বোধন ব্যবহার করেন যা অনেকের কাছে নতুন এবং আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত ইসলামী বক্তৃতাগুলোতে সাধারণত ‘আপনি’ বা ‘আপনারা’ শব্দ ব্যবহার করে শ্রোতাদের সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু আজহারীর এই ভিন্নধর্মী উপস্থাপন পদ্ধতি নিয়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

একদিকে অনেকেই মনে করছেন, এটি একটি বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ, যেখানে বক্তা শ্রোতাদের আরো কাছাকাছি আনতে চেয়েছেন। অন্যদিকে, কিছু মানুষ এটিকে অনাধুনিক বা প্রথাবিরুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন।

আজহারীর ব্যাখ্যা: একটি গভীর বার্তা

মাহফিলের আলোচনার সময়ই আজহারী ‘তুমি’ সম্বোধনের কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন,

> “ইসলামে সবাই সমান। শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য যদি আমার ভাষা সহজ ও হৃদয়গ্রাহী হয়, তবে সেটাই আমার উদ্দেশ্য। আমি আপনাদের সম্মান করি হৃদয়ের গভীর থেকে, এবং ‘তুমি’ শব্দটি আমাদের মাঝে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও স্নেহের সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করে। আল্লাহর বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে এই আন্তরিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

 

আজহারীর এই বক্তব্যে একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে তিনি ইসলামের মূল চেতনা—সহজতা, আন্তরিকতা ও মানবিকতার—প্রচারণায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি ভাষাকে এমন একটি সেতু হিসেবে ব্যবহার করতে চান যা সব বয়সের, সব পেশার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য।

ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি এবং কেউই কারো থেকে ঊর্ধ্বে নয়। মহানবী (সা.) তাঁর জীবনে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কীভাবে মিশতেন, কীভাবে তাঁদের মন জয় করতেন তা ইসলামের ইতিহাসে সুস্পষ্ট।

আজহারীর ‘তুমি’ সম্বোধন এই শিক্ষারই একটি প্রতিফলন। এটি শ্রোতাদের মনে একটি সাম্যের বার্তা দেয়। তিনি বিশ্বাস করেন, বক্তা এবং শ্রোতার মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে বার্তা আরো কার্যকরভাবে পৌঁছায়।

তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। আমাদের দেশে শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা বা বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ‘আপনি’ সম্বোধন করা হয়। এ ক্ষেত্রে আজহারীর ‘তুমি’ ব্যবহারে কিছু শ্রোতা অভ্যস্ত না হওয়ায় তা সামাজিকভাবে আলাদা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।

ভাষার গুরুত্ব: বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যম

মাওলানা আজহারীর এই প্রয়াসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বার্তা এমনভাবে পৌঁছানো যাতে তা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ভাষার ব্যবহার এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ‘তুমি’ একটি ব্যক্তিগত এবং আন্তরিক সম্বোধন। এটি মানুষের মধ্যে একধরনের নৈকট্য সৃষ্টি করে। শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সহজ ভাষা ব্যবহার করার গুরুত্ব বুঝিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্যকে আরো বেশি হৃদয়গ্রাহী করেছেন।

আজহারীর বক্তব্যের ভক্তরা মনে করেন যে, তাঁর এই পদ্ধতি তরুণদের ইসলামের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সাহায্য করবে। তাঁরা বলেন, আধুনিক যুগের মানুষের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছানোর জন্য এ ধরনের উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রয়োজন।

সমালোচনা এবং ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া

আজহারীর এই ‘তুমি’ সম্বোধন নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রতিক্রিয়া এসেছে।

সমালোচনা:

1. প্রথাগত ধর্মীয় নিয়ম লঙ্ঘন: কিছু মানুষ মনে করেন, ‘আপনি’ সম্বোধন ব্যবহার করলে ধর্মীয় বক্তৃতার গাম্ভীর্য বজায় থাকে।

2. সম্মান প্রদর্শনের অভাব: কেউ কেউ এটিকে সম্মানের অভাব হিসেবে দেখছেন।

 

ইতিবাচক দিক:

1. তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা: আজহারীর এই পদ্ধতি তরুণ প্রজন্মের কাছে সহজ ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে।

2. সময়ের সাথে পরিবর্তন: অনেকেই মনে করেন, ধর্মীয় বক্তৃতার ভাষায় সময়ের সাথে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, এবং আজহারী সেই পরিবর্তনের অগ্রদূত।

 

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ

ইসলামের শিক্ষা হলো সহজ ভাষায় মানুষের সঙ্গে কথা বলা। মহানবী (সা.) নিজেও তাঁর সময়ের ভাষায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাই আজহারীর এই প্রয়াস ইসলামের মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

‘তুমি’ সম্বোধনের মাধ্যমে তিনি যে আন্তরিকতা এবং ভালোবাসার বার্তা ছড়াতে চেয়েছেন, তা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে এটি প্রচলিত প্রথার সঙ্গে ভিন্ন হওয়ায় মানুষ এতে অভ্যস্ত হতে সময় নিচ্ছে।

সমাজে প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট

আজহারীর এই উদ্যোগ সমাজে একটি নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এটি শুধু ভাষার পরিবর্তন নয়, বরং ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পদ্ধতিতেও একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তরুণ প্রজন্ম এই পদ্ধতিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে এবং আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো বক্তা এই পদ্ধতিকে অনুসরণ করবেন।

উপসংহার

মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর ‘তুমি’ সম্বোধন শুধুমাত্র একটি ভাষাগত পরিবর্তন নয়, বরং এটি মানুষের হৃদয়ে ইসলামের ভালোবাসা এবং সাম্যের বার্তা পৌঁছানোর একটি প্রয়াস।

তাঁর বক্তব্য আমাদের শেখায়, ধর্মীয় বার্তা সহজ ও হৃদয়গ্রাহী হলে তা মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এই প্রচেষ্টা তরুণ প্রজন্মকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সাহায্য করবে এবং আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনবে।

আশা করা যায়, আজহারীর এই ভিন্নধর্মী উদ্যোগ ভবিষ্যতে আরো ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেবে এবং মানুষের মনে ইসলামের সৌন্দর্যকে নতুনভাবে তুলে ধরবে।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button